বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন

সরকার বিরোধীদের মামলায় সুপারসনিক গতি

সরকার বিরোধীদের মামলায় সুপারসনিক গতি

স্বদেশ ডেস্ক:

– আদালতেই কাটছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সময়
– দিনের সাক্ষী রাতেও নেয়া হচ্ছে

তথ্যপ্রযুক্তি আইনে করা মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে এবং এ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হতে পারে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। রাজধানীর পল্টনে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি জামায়াতের আট নেতার বিচার শুরু হয়েছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানার ১২(১১)১২ নম্বর মামলায় চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলার দ্রুত শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ করে রায় প্রদান নিয়ে আদালত অঙ্গনসহ রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাসসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খানসহ বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নাশকতার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে সাজা দেয়া হতে পারে বলে বিএনপি ও জামায়াতে নেতাদের আইনজীবীরা আশঙ্কা করছেন। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন আরো দু’টি রুজু হলেই তিনি সেঞ্চুরি করবেন; অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৯৮টি মামলা চলমান।

বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের দাবি বিভিন্ন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সরকারবিরোধী মত ও পথের অনুসারীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো সাম্প্রতিক সময়ে সুপারসনিক গতিতে এগোচ্ছে। অর্থাৎ দিনের সাক্ষী রাতেও নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হাজির করতে পুলিশ বিভাগ থেকে দেশব্যাপী স্পেশাল টিম করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে যারা আছেন তাদেরকে সাজা দেয়া এবং বিচারিক হয়রানি করা যেন পুলিশ বিভাগ ও নিম্ন আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের মামলার দ্রুত বিচার করা হচ্ছে এটি মোটেই ঠিক নয়। এটি একটি রাজনৈতিক কথা এবং ভুল কথা বলছেন তারা। রাজনৈতিক কারণে এসব অভিযোগ আনছেন। আইনজীবীরা জানান, নির্বাচনের আগে সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নাশকতার বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে করা অনেক মামলায় বিচার শুরুর আদেশ হয়েছে। আইনজীবীদের তথ্যমতে, চলতি বছর তিন মহানগরেই অন্তত ১০টি নাশকতার মামলায় ৪০০ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন আদালতে গত ২৩ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র আট কার্যদিবসে হত্যা, নাশকতার তিনটি পুরনো মামলায় ১২১ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু ও সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেয়া হয়।

অধিকারের আদিলুর-এলানের কারাদণ্ড : মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সাথে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত এ রায় ঘোষণা করেন। তাদের সাজা দেয়ার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ : শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ঢাকার শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানার আদালতে তিন কার্যদিবস সাক্ষ্যগ্রহণের পর আগামী ২০ সেপ্টেম্বর এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অন্য দিকে সম্প্রতি অধ্যাপক ড. ইউনূসের পক্ষে ১৬০ জনের বেশি নোবেল বিজয়ী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেকেই বিবৃতি দিয়েছেন যে, তাকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। আর ড. ইউনূসের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইন কর্মকর্তার বক্তব্যের পর তার নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ওই বিবৃতির পক্ষে-বিপক্ষে বিবৃতি চলছে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করে সরকার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে। সম্প্রতি নাইকো দুর্নীতি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এ মামলায় সাক্ষী হিসেবে বিদেশী তিন কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রোববার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯ এর বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি মঞ্জুর করে তাদের গ্রহণের অনুমতি দেন। এর মধ্যে একজন এফবিআই কর্মকর্তা ডেব্রা ল্যাপ্রেভোট গ্রিফিথ। আর দু’জন কানাডার পুলিশ কর্মকর্তা কেবিন দু¹ান ও লয়েড শোয়েপ। এই তিনজনকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করতে সমন ইস্যুর আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তিনি আবেদনের বিষয়ে শুনানি করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করেন। তারা আশঙ্কা করছেন দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণ করে এ মামলার রায় দেয়া হতে পারে।

ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি ও জামায়াতের ৮ নেতার বিচার শুরু : ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে ২০১২ সালে রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু আদেশ দিয়েছেন আদালত। গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। একই সাথে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করা হয়।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- যুবদলের নেতা আজিজুল বারি হেলাল, সাইফুল আলম নিরব, মোয়াজ্জেম হোসেন বাবু, কাজী রেজাউল হক বাবু, খন্দকার এনামুল হক এনাম ও জামায়াত নেতা ড. মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম মাসুদ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্টন মডেল থানাধীন মিন্টু রোডে মির্জা ফখরুল ও রিজভীর নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াতের ২০০-২৫০ নেতাকর্মী লাঠসোটা নিয়ে রাস্তা অবরোধ করেন। এ সময় তারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুর করেন ও বিস্ফোরণ ঘটায়।

আইনজীবীদের অভিযোগ বিশেষত রাজনৈতিক মামলাগুলোতে একসাথে অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার জবানবন্দী নেয়া হচ্ছে সাক্ষ্য গ্রহণের আগেই। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আদালতের কোর্ট আওয়ার গণ্য করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কোনো কোনো মামলায় সন্ধ্যার পরও সাক্ষী নেয়া হচ্ছে বলে আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন। আইনজীবীদের অভিযোগ ওপেন কোর্টে সাক্ষীর জবানবন্দী রেকর্ড না করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তা টাইপ করে আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সাক্ষী হাজির করার জন্য পৃথক সমন জারি হচ্ছে না। সাক্ষীদের ডেকে আনা হচ্ছে টেলিফোনে। পছন্দসই সাক্ষ্য না দিলে সেই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে না। কারাবন্দী আসামিদের কারা কর্তৃপক্ষ হাজির না করলে আসামিদের কারাগার থেকে আনা হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থায়। ততক্ষণ পর্যন্ত সাক্ষীদের বসিয়ে রাখা হচ্ছে।

আইনজীবীদেরকে জেরা করার সময় দেয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো আসামির আইনজীবীকে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হচ্ছে।
জবানবন্দী রেকর্ড : মামলার সাক্ষীদের বিশেষ ব্যবস্থায় স্টেনোগ্রাফারদের মাধ্যমে জবানবন্দী টাইপ করা হয়। নিয়ম হচ্ছে উন্মুক্ত আদালতে সাক্ষী জবানবন্দী দেবেন। সেটিই রেকর্ড হবে। এই আলোকে করা হবে জেরা। কিন্তু এসবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলছে ঢাকার আদালগুলোতে বিচারকার্যক্রম।

রাতেও সাক্ষ্য গ্রহণ : উত্তরা পূর্ব থানার মামলা ২৬(১১)১৩। গত ২৬ জুলাই এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় রাত ৯টা পর্যন্ত। ওই দিন পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। এ মামলার পরবর্তী তারিখ দেয়া হয় ২৩ আগস্ট, ৭ সেপ্টেম্বর ও ৪ অক্টোবর। এ মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক অভিযোগ করেন বর্তমানে এ মামলায় ১৫ পরপর তারিখ পড়ছে। অথচ আগে দু-তিন মাস পরপর মামলার তারিখ দেয়া হতো। এ মামলার ৭৭ জন আসামিকেই হাজির হতে হচ্ছে প্রত্যেক তারিখে।
দক্ষিণ খান থানায় দায়েরকৃত মামলা নং-২৯(১১)১৩। গত ১৪ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। সাক্ষ্য নেয়া হয় মাত্র দু’জনের। এরপর ২০ আগস্ট, ৪ সেপ্টেম্বর ও ১৭ সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হয় বলে আইনজীবীরা জানান। এ মামলায় হাজির থাকতে হয় ৮২ আসামিকেই। ধার্য তারিখে কারাগার থেকে আসামি হাজির না করায়, সাক্ষীদের বসিয়ে রেখে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কারাগার থেকে আসামিকে হাজির করা হচ্ছে।

বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলা নং-৬৭৯/২০১৫ (পল্টন থানা : ৪২(১০)১৩) মামলায় গত ২৪ জুলাই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালত-১৩ তে অফিস টাইমের পর সন্ধ্যা পর্যন্ত সাক্ষ্য নেয়া হয় বলে ওই মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

খিলগাও থানার ৩০(১১)১৩ নম্বর মামলায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) সাক্ষ্য চলাকালে বাদির জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। দায়রা কোর্টে মামলা নং-১৩৩২৮/১৭। মতিঝিল থানার ৩৮(১)২২ নম্বর মামলা ও রমনা থানার ২৩(১১)১৩ নম্বর মামলায় অন্যান্য সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের আগেও তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। কোর্ট প্রাক্টিস অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয় সবার শেষে।

একই সময় ঢাকা ও খুলনার মামলা : আইনজীবীরা জানান, মতিঝিল থানার ১২(১১)১২ নম্বর মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে গত ২৯ আগস্ট চার্জ গঠন করা হয়। একই সাথে ১৭ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রাখা হয়। মামলাটি ৫ নভেম্বর ২০১২ সালের দায়ের করা। একই সময় অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় মামলায় দায়ের করা হয়। যার নং-৩(১১)১২। একজন ব্যক্তি একই সময় ঢাকা ও খুলনায় অবস্থান করেন কী করে? আদালতে খুলনার মামলার সার্টিফাইড কপি জমা দেয়া হয়। কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেননি।
কারাগারে থেকেও নতুন রাজনৈতিক মামলায় আসামি : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান দুই বছর ধরে কারাবন্দী। ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন তিনি। সেই থেকে তিনি কারাগারে। ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ঘটনার তারিখ উল্লেখ করে কলাবাগান থানায় একটি মামলা [নং-৭(১)২৩] হয়। গত ২৩ মার্চ এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মহানগর হাকিম আদালতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন দেয়।

বিশেষ তৎরপতায় পুলিশ : আইনজীবীদের অভিযোগ ডিসি প্রসিকিউশন ও এডিসি প্রসিকিউশন সাক্ষ্য চলাকালে কোর্টে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। বিশেষ বিশেষ মামলা থাকলে তাদের ‘আমলনামা’ ভারী হয়- মর্মে আদালত অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে। পুলিশ আদালতে বিশেষ এই নজরদারি বাড়িয়েছে সরকারি নির্দেশনার পরপরই।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে হওয়া শতাধিক মামলার তদন্ত দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে যেসব মামলার চার্জশিট হয়েছে সেগুলো পর্যবেক্ষণে রয়েছে। মামলাগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করারও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মনিটরিং কমিটিকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি এবং স্থগিত মামলা সচলেরও নির্দেশনা দেয়া হয় সংশ্লিষ্টদের।

সরকারি নির্দেশনার পরপরই রাজনৈতিক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি শুরু হয়েছে বলে আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার রায় দেয়া হয়েছে। গত ২ আগস্ট তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমানকে ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় যথাক্রমে ৯ বছর ও ৩ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার জজ আদালত। চার্জ গঠনের মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যেই রায় হয় এ মামলার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা দু’টি দুর্নীতির মামলায় বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আমানউল্লাহ আমানকে বিচারিক আদালতের দেয়া কারাদণ্ড গত ৩০ মে বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ মামলায় গত ১০ সেপ্টেম্বর কারাগারে পাঠানো হয় আমানউল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানকে। সাবেরা আমান উচ্চ আদালতে থেকে জামিন পেলেও আমানউল্লাহ আমান জামিন পাননি। অন্য দিকে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আত্মসমর্পণ না করায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

এ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলায় গত ১৭ আগস্ট প্রবীণ সাংবাদিক প্রবাসী শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানসহ পাঁচজনকে পৃথক দু’টি ধারায় সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আদালতেই কাটছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সময় : গায়েবি মামলা। জামিন। নিয়মিত হাজিরা। একেকজনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চার শ’ পর্যন্ত মামলা। কারো বিরুদ্ধে ৫০, কারো বিরুদ্ধে ১০০ মামলা। ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে ও অর্ধশতাধিক মামলা। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির দাবি, গত দেড় দশকে বিএনপির ৪০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় অনেক নেতাকর্মীকে মাসের কর্মদিবসের প্রায় সব দিনই থাকতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। কারাগার ও কোর্ট-কাচারি যেন তাদের বাড়িঘর। কোনো না কোনো মামলায় প্রায় প্রতিদিনই হাজির থাকতে হচ্ছে আদালতে। হাজিরা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরছেন। কেউ কেউ আদালত থেকে কারাগারে যাচ্ছেন। পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। পরের দিন সকালেই অন্য মামলায় হাজিরার জন্য তাকে তোলা হচ্ছে আদালতে। প্রতিদিন ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে এখন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ভিড়। এদের মধ্যে কেউ কেউ দিনে একটি-দু’টি নয়, ৮ থেকে ১০ মামলার হাজিরা দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরিুদ্ধে মামলাগুলো সম্প্রতি সময় সুপারসনিক গতিতে এগোচ্ছে। অর্থাৎ দিনের সাক্ষী রাতেও নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হাজির করতে পুলিশ বিভাগ থেকে দেশব্যাপী স্পেশাল টিম করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে যারা আছেন তাদেরকে সাজা দেয়া এবং বিচারিক হয়রানি করা যেন পুলিশ বিভাগ ও নিম্ন আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে আমরা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো বিশ^াসযোগ্য পত্রিকায় লিখেছে, বাংলাদেশের কিছু কিছু আদালত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এর থেকে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক নোবেল বিজয়ী, রাজনীতিবিদ কেউই বাদ পড়ছেন না। তিনি বলেন, সরকার বিরোধী মতের সবাইকে দমন করার জন্য বিচার বিভাগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের মামলার দ্রুত বিচার করা হচ্ছে এটি মোটেই ঠিক নয়। এটি একটা রাজনৈতিক কথা এবং ভুল কথা বলছেন তারা। রাজনৈতিক কারণে এসব অভিযোগ আনছেন তারা। এর কোনো ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে মামলা হয়েছে। ১৬ বছর আগের এ মামলায় মাত্র সাক্ষ্য শুরু হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০১২ সালে রাজধানীর পল্টন মডেল থানাও ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতাদের বিচার শুরু হয়েছে। অথচ সিএমএম আদালতে ২০১২ সালের কয়টি মামলা আছে দেখুন। কাজেই তারা যেটা বলতে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং এর কোনো ভিত্তি নেই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877